ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন নয়,
বরং সরকারের গ্যারান্টিতে বিদ্যুৎ খাতে ২০ হাজার
কোটি টাকা ঋণ দেয়ার
প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংকে
এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে
ঋণ প্রস্তাব জমা পড়েছে।
দুই মাসের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেবে বলে সংশ্লিষ্ট
ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
বেসরকারি খাতে ১ হাজার
৭৬৮ মেগাওয়াটক্ষমতার ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের
প্রস্তাব ৯ আগস্ট অনুমোদন
দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত
মন্ত্রিসভা কমিটি। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো
নির্মাণ করবে এপিআর এনার্জি,
এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস লিমিটেড, বাংলা ট্র্যাক লিমিটেড,
কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস লিমিটেড,
দেশ এনার্জি, মিডল্যান্ড পাওয়ার, ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট
এবং সামিট করপোরেশন ও
সামিট পাওয়ারের কনসোর্টিয়াম। এসব
প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন
ব্যাংকে ঋণ আবেদন জমা
দিয়েছে। এসব
বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খুব বেশি আগ্রহ
না থাকলেও অতি উত্সাহী
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। যদিও
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা বেশ নাজুক। মূলধন
হিসেবে গত আট বছরে
সাড়ে ১৪ হাজার কোটি
টাকা জোগান দিয়েছে সরকার। গত
অর্থবছরও জোগান দেয়া হয়েছে
প্রায় ২ হাজার কোটি
টাকা। মূলধন
ঘাটতি মেটাতে বন্ডের মাধ্যমে
আরো প্রায় ১৫ হাজার
কোটি টাকা চেয়েছে ব্যাংকগুলো।
১০০ মেগাওয়াট করে দুটি ও
২০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের
প্রস্তাব পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী
ব্যাংক। জানতে
চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম বণিক বার্তাকে
বলেন, এর আগে আটটি
বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্রণী ব্যাংক ঋণ
দিয়েছিল। সেগুলোর
মধ্যে পাঁচটি এরই মধ্যে
সব ঋণ পরিশোধ করেছে। বাকি
তিনটির ঋণও নিয়মিত আছে। নতুন
করে পাওয়া প্রস্তাবগুলো এখনো
প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের
পক্ষ থেকে গ্যারান্টি দেয়ার
বিষয়টি প্রস্তাবনায় আছে বলে শুনেছি। ভালো
গ্রাহক পেলে আমরা ঋণ
দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই
বিবেচনা করব।
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে
প্রস্তাব পেয়েছে সোনালী ব্যাংকও। সরকারের
নিশ্চয়তায় তারাও ঋণ অনুমোদনের
কথা ভাবছে বলে জানান
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ্ আল
মাসুদ। তিনি
বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে
বর্তমানে ১ লাখ কোটি
টাকার মতো অতিরিক্ত তারল্য
আছে। এর
মধ্যে শুধু সোনালী ব্যাংকেরই
রয়েছে ৬০ হাজার কোটি
টাকা। বেসরকারি
অনেক ব্যাংকের কাছে বিনিয়োগ করার
মতো অর্থ নেই।
এ অবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় প্রকল্পে
বিনিয়োগের বেশি সুযোগ রয়েছে
সোনালী ব্যাংকের। বড়
ঋণের কিছু আবেদন আমাদের
কাছে আছে। সরকার
গ্যারান্টি দিলে ভালো গ্রাহক
দেখে আমরা ঋণ অনুমোদন
দেব। সরকারের
নিশ্চয়তায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঋণ অনুমোদনে প্রস্তুত
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকও।
তবে নতুন করে এখন
পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব ব্যাংকটি
পায়নি বলে জানা গেছে। ওরিয়নের
একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরখানেক আগে সোনালী ব্যাংকের
সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাবনা
অনুমোদন করা হয়েছিল বলে
জানান রূপালী ব্যাংকের এমডি
মো. আতাউর রহমান প্রধান। জানা
যায়, গত ২১ জুন
ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে
সভায় ছয় মাসের মধ্যে
বিদ্যুৎ খাতে ২০ হাজার
কোটি টাকা ঋণ দিতে
ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানান
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
কিন্তু বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন
অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে অল্প সময়ের
মধ্যে এ পরিমাণ ঋণ
দেয়া অসম্ভব বলে সভায়
মন্তব্য করেন ব্যাংকাররা।
আইনি জটিলতা নিরসনে অর্থ
মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত
সচিব জালাল আহমেদকে আহ্বায়ক
করে গত ৪ জুলাই
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে একটি কমিটি
গঠন করা হয়।
২০ জুলাই অনুষ্ঠিত কমিটির
বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা ব্যাংক কোম্পানি আইন
সংশোধন না করে সরকারের
গ্যারান্টিতে বিদ্যুৎ খাতে ঋণ দেয়ার
পক্ষে মত দেন।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি ব্যাংক কোম্পানি আইনের
২৬খ (৩) ধারা অনুযায়ী
ঋণ দেয়ার কথা বলেন। এ
ধারা অনুযায়ী, সরকারি নিশ্চয়তা পেলে
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মূলধনের
২৫ শতাংশ ঋণসীমা রাখার
বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতির সুযোগ
রয়েছে। চলতি
সপ্তাহেই এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন
জমা দেয়ার কথা রয়েছে
কমিটির। অর্থ
মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের
জ্যেষ্ঠ সচিব মো. ইউনুসুর
রহমান বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে
ব্যাংকগুলোর অর্থায়নের সঙ্গে অনেকগুলো কর্তৃপক্ষ
জড়িত। অর্থ
বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদকে
আহ্বায়ক করে একটি কমিটি
গঠন করা হয়েছে।
তারা এরই মধ্যে কার্যক্রম
শুরু করেছে। কমিটির
প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত
সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তবে দেশে রেন্টাল ও
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় বলে
জানান ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের
(এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান। বণিক
বার্তাকে তিনি বলেন, এর
আগে অনুমোদন পাওয়া বেশ কয়েকটি
বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেয়া ঋণ খেলাপি
হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ
উত্পাদনের অভিজ্ঞতা নেই, এমন অনেক
প্রতিষ্ঠান ওই সময় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র
অনুমোদন পেয়েছিল। ওইসব
প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ করতে
পারছে না। একাধিকবার
পুনঃতফসিল করেও ঋণের অর্থ
আদায় করা যাচ্ছে না। নতুন
করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের আগে ব্যাংকগুলোকে এসব
বিষয় ভাবতে হবে। নতুন অনুমোদনপ্রাপ্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর
দুটি নির্মাণ হবে ঢাকার কেরানীগঞ্জে। এর
একটি স্থাপন করবে এপিআর
এনার্জি ও এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল
প্রজেক্টস লিমিটেড। এছাড়া
বাংলা ট্র্যাক লিমিটেডের যশোরের নওয়াপাড়ায় ১০০
মেগাওয়াট ও কুমিল্লার দাউদকান্দিতে
২০০ মেগাওয়াটের এইচএসডিভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন
পেয়েছে। ডিজেলচালিত
এসব কেন্দ্র হবে পাঁচ বছর
মেয়াদি। অনুমোদন
দেয়া বাকি ছয়টি কেন্দ্র
হবে এইচএফওভিত্তিক ও ১৫ বছর
মেয়াদি। এর
মধ্যে বগুড়ায় কনফিডেন্স পাওয়ার
হোল্ডিংস লিমিটেড ১১৩ মেগাওয়াট, চাঁদপুরে
দেশ এনার্জি ২০০, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মিডল্যান্ড
পাওয়ার ১৫০, খুলনার লবণচরায়
ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট ১০৫
এবং গাজীপুরের কড্ডায় সামিট করপোরেশন
ও সামিট পাওয়ার কনসোর্টিয়াম
৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে।